কুড়িগ্রামে নদীশাসন ও ভাঙন রোধের কথা বলে দুধকুমার নদীর বুকে নির্বিচারে বালু ফেলে ভরাট করা হয়েছে। নদী রক্ষার নামে চলছে নদী হত্যার ষড়যন্ত্র। পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতি এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এর ফলে এক সময়ের খরস্রোতা দুধকুমার নদী এখন মৃতপ্রায়। দুধকুমার নদীর স্বাভাবিক স্রোত কার্যত বন্ধ হয়ে নদীটি এখন বালুচরে পরিণত হয়েছে। স্থানীয়রা এ প্রকল্পকে ব্যঙ্গ করে ‘নদী মারার প্রকল্প’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। নদী বিশেষজ্ঞরদের মতে, নদীটি পুরোপুরি মরে গেলে ওই এলাকায় পানিসংকট, কৃষি উৎপাদন হ্রাস এবং জলবায়ু মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে। জানা গেছে, দুধকুমার নদীর একটি শাখা কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের চর যাত্রাপুর হয়ে উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মোল্লারহাট এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদে মিলিত হয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে চর যাত্রাপুর হয়ে বলদীপাড়ার দুধকুমার নদীর ডান তীরে ৫০০ মিটার নদীশাসন কাজ শুরু করে সরকার। এ কাজের ঠিকাদারি পায় ‘আরইউএসএইচ জেভি’ নামের প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পটির চুক্তিমূল্য ১৪ কোটি ৮৯ লাখ ৭১ হাজার ৬৬৯ টাকা। ২০২৫ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী কুড়িগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মোস্তাফিজার রহমান সাজু। কিন্তু এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের পর উল্টো নদী তার অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, নদীর গভীরতা বাড়িয়ে স্বাভাবিক গতিপথ বজায় রাখার কথা থাকলেও বাস্তবে হয়েছে তার বিপরীত। নদীর মাঝ বরাবর হাজার হাজার জিও ব্যাগ ফেলে তলদেশ ভরাট করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি জিও ব্যাগে প্রায় ২৫০ কেজি বালু ভর্তি ছিল। এতে নদীর প্রশস্ততা ও গভীরতা কমে গিয়ে পানি চলাচলের পথ প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দুধকুমার নদীর পানি শুকিয়ে তা বালুচরে রূপ নিয়েছে। স্থানীয় কৃষক জেল হক আলী বলেন, ‘আগে এটা ছিল গভীর নদী, খুব ভাঙতো। ভাঙন ঠেকাতে সরকার ব্লক পিচিংয়ের বরাদ্দ দেয়। কিন্তু ঠিকাদার নদীতে জিও ব্যাগ ফেলে দেওয়ায় অল্প সময়েই নদী ভরাট হয়ে যায়। এখন নদীর পাশে চর পড়েছে, সেখানে চাষাবাদ হচ্ছে।’ স্থানীয় বাসিন্দা শাজাহান আলী বলেন, ‘নদী কাটার কথা ছিল, কিন্তু কাটা হয়নি। উল্টো নদীর পেটে বালু ভরা হয়েছে। এখন নদী শুধু নামে আছে, পানি নেই।’ বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রবণতা। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় কৃষকরা ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। এতে ভবিষ্যতে পানির স্তর নেমে যাবে, খরা পরিস্থিতি তীব্র হবে এবং কৃষি উৎপাদন মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকল্পের ঠিকাদার প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তাফিজার রহমান সাজু বর্তমানে এলাকা ছাড়া। ফলে মাঠে কাজের কোনো কার্যকর তদারকি হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড নদীর প্রকৃত অবস্থা যাচাই না করেই বিল পরিশোধ করেছে বলেও দাবি তাদের। তবে কাজ এখনো শেষ হয়নি। গত বছর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপি সমর্থক ও যাত্রাপুর ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুল আউয়াল কিছুদিন এ কাজের দেখভাল করেন। তিনি কুড়িগ্রামের ঠিকাদার আবদুর রাজ্জাকের হয়ে মাঠ পর্যায়ে তদারকি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে ইউপি সদস্য আবদুল আউয়াল বলেন, সরকার পতনের পর আমি কিছুদিন কাজ দেখভাল করেছিলাম। কিন্তু কাজের অনিয়ম বুঝতে পেরে পরে সরে এসেছি। প্রকল্প বাস্তবায়নের তদারকিতে ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ রাকিবুল হাসান, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আবদুল কাদের ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম। কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান বলেন, দুধকুমার নদীর তীর রক্ষার জন্য প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। ডিজাইন অনুযায়ী তীর থেকে ৩৩ মিটার স্লোপ এলাকায় জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের অনুমোদন রয়েছে। অনুমোদিত নকশা অনুযায়ীই কাজ করা হয়েছে। কুড়িগ্রাম জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক লিয়াকত আলী বলেন, ‘জেলায় নদী শাসনের নামে শত শত কোটি টাকার প্রকল্প চলছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মূল ঠিকাদার কাগজে থাকলেও মাঠে দালালদের মাধ্যমে কাজ হয়। বলদীপাড়ার প্রকল্প নিয়েও আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে। এতে দুধকুমার নদী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ এ বিষয়ে রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির সদস্য এবং নদী কর্মী জাহানুর রহমান বলেন, ‘নদী শাসনের নামে দুধকুমার নদীর বুকে জিও ব্যাগ ফেলে ভরাট করা নদী ব্যবস্থাপনার মৌলিক নীতির পরিপন্থি। নদীশাসনের উদ্দেশ্য হলো স্বাভাবিক স্রোত বজায় রেখে ভাঙন নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু এখানে নদীর মাঝখান ভরাট করে কার্যত নদীর মৃত্যু ডেকে আনা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, এর ফলে এলাকার জলচক্র ব্যাহত হবে, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়বে, কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং খরা ও পানি সংকটসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়বে। একইসঙ্গে তিনি প্রকল্পটির নিরপেক্ষ তদন্ত এবং অবিলম্বে ভরাট বন্ধ করে দুধকুমার নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে এনে পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখার দাবি জানান। রোকনুজ্জামান মানু/এফএ/এএসএম