নির্বাচনে কখনো হারেননি খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা হেরেছিলেন ৩ আসনে

১৯৮১ সালে স্বামী রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলের হাল ধরে বিএনপিকে সরকারে আনেন গৃহবধূ খালেদা জিয়া। শুধু তাই নয়, দেশের প্রথম এবং ইসলামী বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বয়ে এনেছিলেন সম্মান। স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতন ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক যাত্রায় দেশকে উত্তরণের অগ্রণী ভূমিকায় যার নেতৃত্ব বিরোধীদের মুখেও হয়ে ওঠে অন্যন্য। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য স্বৈশাসকের পতনের পর ১৯৯১ সালে প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে পাঁচ-পাঁচটি আসনেই জয়লাভ করেন। এরপর যতবার ভোটের লড়াইয়ে নেমেছেন কখনো হারেননি। রাজনৈতিক জীবনে পাঁচটি সংসদ নির্বাচনে মোট ২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২৩টিতেই পেয়েছেন জয়। অন্যদিকে দেশের রাজনীতিতে আরেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর ১৯৮১ সালে দলটির নেতৃত্ব পেয়ে দেশে ফেরেন ১৭ মে। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। অংশ নেন সাতটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এতে মোট ১৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে হেরে যান তিনটি আসনে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পরিসংখ্যান থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ইসি থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯৯১ সালের ৪ এপ্রিলের নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বিএনপি ওই নির্বাচনে ১৪০টি আসনে জয়লাভ করে। এতে বেগম জিয়া একাই বগুড়া-৭, ঢাকা-৫, ঢাকা-৯, ফেনী-১ ও চট্টগ্রাম-৮; মোট পাঁচটি আসনে জয়লাভ করেন। পঞ্চম জাতীয় জাতীয় সংসদের ওই নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একটি আসনে জয়লাভ করেন। ওই নির্বাচনে ঢাকা-৭ ও ঢাকা-১০ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হতে না পারলেও গোপালগঞ্জ-৩ আসন থেকে জয়লাভ করেন তিনি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-১ ও ২, বগুড়া-৭, সিরাজগঞ্জ-২ ও রাজশাহী-২ আসন থেকে নির্বাচন করে পাঁচটি আসনেই জয়লাভ করেন খালেদা জিয়া। ওই নির্বাচন আওয়ামী লীগ বর্জন করে। তবে ওই সংসদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করার পর সংসদ ভেঙে দিয়ে পুনরায় নির্বাচন দেন বেগম জিয়া। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও খালেদা জিয়া পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বগুড়া-৬, বগুড়া-৭, ফেনী-১, লক্ষ্মীপুর-২ ও চট্টগ্রাম-১ আসনে জয় লাভ করেন। তবে এই নির্বাচনে বিএনপি ১১৩ আসন পেলেও সরকারে আসতে পারেনি। নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে শেখ হাসিনা তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনটিতেই জয়লাভ করেন। তার আসনগুলো ছিল বাগেরহাট-১, খুলনা-১ ও গোপালগঞ্জ-৩ আসন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-১, লক্ষ্মীপুর-২, খুলনা-২, বগুড়া-৬ ও ৭ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সব ক’টিতেই জয়লাভ করেন খালেদা জিয়া। অন্যদিকে শেখ হাসিনা পাঁচটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জয়লাভ করেন চারটিতে। বরগুনা-৩, নড়াইল-১ ও ২, রংপুর-৬, গোপালগঞ্জ-৩ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তবে রংপুর-৬ আসনে তিনি জয়ী হতে পারেননি। এই নির্বাচনে বিএনপি ১৯৩টি আসন পেয়ে সরকারে আসে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করতে না পারলেও বেগম জিয়া বগুড়া-৬ ও ৭, ফেনী-১ আসনে নির্বাচন করে তিনটিতেই জয়লাভ করেন। ওই নির্বাচনে শেখা হাসিনাও গোপালগঞ্জ-৩, বাগেরহাট-১ ও রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন। ওই নির্বাচনে বিএনপি ৩০টি পেয়েছিল। এরপরের তিনটি নির্বাচনই দলীয় সরকারের অধীনে আয়োজন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার। তার আগে সংবিধান সংশোধন করে বাদ দেওয়া হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। শেখ হাসিনা এই নির্বাচনে রংপুর-৬ ও গোপালগঞ্জ-৩ আসন থেকে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ১৫৩ আসেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপের পর বিএনপি অংশ নিলেও খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল করেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। নির্বাচনে ফেনী-১, বগুড়া-৬ ও ৭ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন তিনি। পরে রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে আপিল করলে শুনানি শেষে কমিশন রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন। ২০১৮ সালের ৮ ডিসেম্বরের শুনানিতে আইনজীবি এ জে মোহাম্মদ আলী যুক্তিতর্কে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, যে মামলার কারণ দেখিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল করেছেন, তিনি সে মামলায় সাজাপ্রাপ্ত নন। বারবার তিনি একই ব্যাখ্যা দেওয়ার পর পুনর্বিবেচনা করে শুনানির রায় পরে জানানোর কথা জানান ইসি সচিব। পরে কমিশন রিটার্নিং কর্মকর্তার আদেশ বহাল রেখে রায় ঘোষণা করে। নির্বাচনে শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জ-৩ আসন থেকে জয়লাভ করেন। রাতের ভোটের খ্যাতি পাওয়া এই নির্বাচনে বিএনপি মাত্র সাতটি আসন পায়। ফের ক্ষমতায় যায় আওয়ামী লীগ। পরে ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বিএনপি বর্জন করে। এই নির্বাচনে শেখ হাসিনা গোলাগঞ্জ-৩ ও রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন দেখাতে নিজেদের প্রার্থীদেরই আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচনে দাঁড় দেওয়ায় এই নির্বাচনকে ডামি ভোট বলে খ্যাতি পায়। এতে আবারও ক্ষমতার মসনদে বসে আওয়ামী লীগ। তবে ওই সংসদের এক বছরও পার হয়নি, জুলাই আন্দোলনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা ও তার দলের এমপি-মন্ত্রীরা। পরে সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি। গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অংশ নিতে গত ২৯ ডিসেম্বর তিনটি আসনে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়। কিন্তু পরদিন ভোর ৬টায় মারা যান খালেদা জিয়া। এর মধ্যদিয়ে বারবার নির্বাচিত দেশের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীর আপসহীন রাজনৈতিক আখ্যানের পরিসমাপ্তি ঘটে। এমওএস/ইএ/এএসএম