ট্রাম্পের শুল্ক নীতি কুখ্যাত 'স্মুট-হলি অ্যাক্ট'-এর চেয়েও মারাত্মক

ডনাল্ড ট্রাম্পের বর্তমান শুল্ক নীতিকে ১৯৩০ সালের কুখ্যাত 'স্মুট-হলি শুল্ক আইন'-এর সঙ্গে তুলনা করা এবং একে তার চেয়েও ক্ষতিকর বলাটা অর্থনীতির ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুতর পর্যবেক্ষণ। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, ২০২৫ সালে বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় না ঘটার পেছনে কিছু সাময়িক কারণ ছিল, যার মেয়াদ ২০২৬ সালে ফুরিয়ে আসবে। অর্থাৎ, শুল্ক নীতির আসল ধাক্কাটা ২০২৬ সালে পূর্ণ শক্তিতে অনুভূত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল।২০২৫ সালে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ হলো খুচরা বিক্রেতাদের মজুদ। শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগে মার্কিন আমদানিকারক ও বিক্রেতারা প্রচুর পরিমাণে পণ্য মজুদ করেছিলেন। ফলে বছরের বড় একটা সময় তারা পুরনো দামেই পণ্য বিক্রি করতে পেরেছেন। কিন্তু ২০২৬ সালের শুরুতে এই মজুদ শেষ হয়ে আসবে এবং বিক্রেতাদের নতুন করে চড়া শুল্ক দিয়ে পণ্য আমদানি করতে হবে। তখন সেই বাড়তি খরচ তারা সরাসরি ক্রেতাদের ওপর চাপিয়ে দেবেন, যার ফলে নিত্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়তে শুরু করবে।১৯৩০ সালের স্মুট-হলি ছিল একটি বদ্ধ অর্থনীতির দেশ বাঁচানোর ভুল প্রচেষ্টা। আর ট্রাম্পের শুল্ক নীতি হলো একটি অত্যন্ত উন্মুক্ত ও আন্তঃনির্ভরশীল বিশ্ব অর্থনীতির ভিত নাড়িয়ে দেওয়া এক পদক্ষেপ। যে অর্থনীতি যত বেশি উন্মুক্ত, সেখানে সংরক্ষণবাদী নীতি তত বেশি বিষাক্ত। এই কারণেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ২০২৬ সালের মধ্যে এই শুল্ক নীতির প্রভাবে যে অর্থনৈতিক সংকোচন ঘটবে, তা স্মুট-হলির ঐতিহাসিক দুঃস্বপ্নকেও ম্লান করে দিতে পারে।স্মুট-হলি অ্যাক্ট কী ছিল? ১৯৩০ সালে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বা মহামন্দার কবলে পড়ে, তখন মার্কিন কংগ্রেস স্মুট-হলি আইন পাস করে। এর উদ্দেশ্য ছিল উচ্চ শুল্ক আরোপ করে দেশীয় কৃষিপণ্য ও শিল্পকে বিদেশি প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করা। এর ফলে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর শুল্কের হার গড়ে প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এর ফলাফল হয়েছিল হিতে বিপরীত। অন্যান্য দেশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করলে বিশ্ব বাণিজ্য ৬৬ শতাংশ হ্রাস পায় এবং মহামন্দার ভয়াবহতা বহুগুণ বেড়ে যায়। অর্থনীতিবিদদের মতে, ট্রাম্পের নীতি স্মুট-হলিকে ছাড়িয়ে গেছে।বিশ্ব বাণিজ্যের আন্তঃনির্ভরশীলতা (গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন): ১৯৩০ সালে বিশ্ব অর্থনীতি আজকের মতো এত বেশি সংযুক্ত ছিল না। বর্তমান যুগে একটি পণ্য (যেমন একটি আইফোন বা গাড়ি) তৈরি হতে কয়েক ডজন দেশের কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হয়। ট্রাম্প যখন ঢালাওভাবে ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক এবং চীনের পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ বা তার বেশি শুল্ক আরোপের কথা বলেন, তখন তা কেবল তৈরি পণ্যের দাম বাড়ায় না, বরং উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে আঘাত করে।স্মুট-হলির সময় সরবরাহ ব্যবস্থা এত জটিল ছিল না, তাই বর্তমানের ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি গভীরে পৌঁছাবে।স্মুট-হলির সময় স্বর্ণমান প্রচলিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে ফিয়াট কারেন্সি বা ডলার-ভিত্তিক অর্থনীতিতে শুল্ক আরোপ মানেই সরাসরি মুদ্রাস্ফীতি। শুল্কের কারণে যখন আমদানিকৃত কাঁচামালের দাম বেড়ে যায়, তখন মার্কিন কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের দাম বাড়াতে বাধ্য হয়। এটি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যায়, যা ১৯৩০-এর দশকে কল্পনা করা কঠিন ছিল। জেফরি ফ্র্যাঙ্কেলের মতো অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২৬ সালে এই ‘কস্ট-পুশ ইনফ্লেশন’ মার্কিন অর্থনীতিকে স্থবির করে দিতে পারে।১৯৩০ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক বাড়িয়েছিল, তখন পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে অন্যান্য দেশ শুল্ক বাড়াতে কিছুটা সময় নিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানের ডিজিটাল এবং দ্রুতগতির বিশ্বে পাল্টা ব্যবস্থা তাৎক্ষণিক। ট্রাম্পের ঘোষণার সাথে সাথেই চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মেক্সিকো পাল্টা শুল্কের তালিকা প্রস্তুত করে ফেলেছে। বর্তমানের বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) বা অন্য বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো অনেকটা অকার্যকর, ফলে এই বাণিজ্য যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি স্মুট-হলির চেয়েও বেশি।স্মুট-হলি কৃষকদের রক্ষার জন্য আনা হলেও তা শেষ পর্যন্ত মার্কিন কৃষিকে ধ্বংস করেছিল। বর্তমান ট্রাম্পের আমলেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে কিন্তু আরও বড় আকারে। মার্কিন সয়াবিন, ভুট্টা এবং মাংসের বড় বাজার হলো চীন। যখন ট্রাম্প শুল্ক বাড়ান, চীন পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে মার্কিন কৃষি পণ্য কেনা বন্ধ করে দেয়। গত কয়েক বছরে মার্কিন কৃষি খাতের লোকসান এবং সরকারি ভর্তুকির পরিমাণ ১৯৩০-এর দশকের আনুপাতিক হিসাবকেও হার মানিয়েছে।কাঠামোগত ভিন্নতা: স্মুট-হলি ছিল একটি সুনির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়া যা কংগ্রেসের মাধ্যমে পাস হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্ক নীতি অনেকটাই নির্বাহী আদেশের ওপর নির্ভরশীল এবং অনেক ক্ষেত্রে এটি খেয়ালি বা অনিশ্চিত। এই অনিশ্চয়তা শেয়ার বাজার এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য ১৯৩০ সালের স্থিতিশীল (যদিও নেতিবাচক) আইনের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর। বিনিয়োগকারীরা যখন জানেন না কাল কোন দেশের ওপর কত শতাংশ শুল্ক বসবে, তখন তারা বিনিয়োগ থেকে পিছিয়ে যান, যা দীর্ঘমেয়াদে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দেয়।২০২৫ সালের শুরুতে ডনাল্ড ট্রাম্প যখন দ্বিতীয়বারের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন অধিকাংশ অর্থনীতিবিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল। তাদের প্রধান আশঙ্কার কারণ ছিল ট্রাম্পের ঘোষণা করা নজিরবিহীন শুল্ক নীতি। ধারণা করা হয়েছিল, আমদানিকৃত পণ্যের ওপর চড়া শুল্ক আরোপের ফলে ভোগ্যপণ্য এবং কাঁচামালের দাম বেড়ে যাবে, যার অবধারিত ফল হিসেবে মূল্যস্ফীতি আকাশচুম্বী হবে এবং সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাবে।বছরের শেষ দিকে এসে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্পের এই শুল্ক নীতি ১৯৩০ সালের কুখ্যাত ‘স্মুট-হলি অ্যাক্ট’-এর ক্ষতিকর প্রভাবকেও ছাড়িয়ে গেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই শুল্ক নীতি কার্যকরের পরও ২০২৫ সালে মার্কিন অর্থনীতি যতটা ধসে পড়ার কথা ছিল, ততটা পড়েনি।সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ২.৭ শতাংশ। ২০২৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত হিসাব বলছে, এই হার খুব একটা বাড়েনি, বরং একই অবস্থানে থিতু হয়ে আছে। ট্রাম্প যদিও দাবি করছেন যে, তিনি পণ্যের দাম কমিয়ে এনেছেন, কিন্তু বাস্তবতা হলো পণ্যের দাম কমেনি বরং আগের চেয়ে বেড়েছে; কেবল বৃদ্ধির গতিটা আপাতত থমকে আছে।এছাড়াও ট্রাম্প দাবি করেছিলেন যে, রপ্তানিকারক দেশগুলো এই শুল্কের বোঝা বহন করবে। কিন্তু পরিসংখ্যানে দেখা গেছে মার্কিন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোই এই বাড়তি অর্থ পরিশোধ করছে। আপাতত তারা মুনাফার মার্জিন কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিলেও ২০২৬ সালে তারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চাইবেন।শুল্ক নীতির বিরূপ প্রভাব কেবল মূল্যস্ফীতিতেই সীমাবদ্ধ নেই, এটি মার্কিন কর্মসংস্থান বাজারেও ধীরগতি নিয়ে এসেছে। ২০২৪ সালে মার্কিন অর্থনীতিতে প্রতি মাসে গড়ে যে পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতো, ২০২৫ সালে তা প্রায় ৬৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বছরের শেষ দিকে বেকারত্বের হার বেড়ে ৪.৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২৫ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র ১ লাখ ৫ হাজার চাকরি হারিয়েছে এবং নভেম্বরে মাত্র ৬৪ হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। কর্মসংস্থানের এই মন্দাভাব ২০২৬ সালে আরও গভীর হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কাঁচামালের বাড়তি দামের কারণে উৎপাদন কমাতে বাধ্য হচ্ছে। মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের অবস্থানও এই পরিস্থিতিতে অত্যন্ত নাজুক।প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারবার সুদের হার কমানোর জন্য চাপ দিলেও মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বিবেচনায় ফেড সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল স্পষ্ট জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশে নামিয়ে আনাই তাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু ট্রাম্পের শুল্ক নীতি বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলায় ফেড চাইলেও সুদের হার দ্রুত কমাতে পারছে না। এর ফলে একদিকে চড়া ঋণ খরচ এবং অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়। এই দ্বিমুখী চাপে মার্কিন ভোক্তারা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন।সাম্প্রতিক জনমত জরিপ বলছে, প্রায় অর্ধেক আমেরিকান মনে করছেন তাদের আর্থিক অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপ হচ্ছে। ২০২৬ সালের জন্য আরও একটি বড় উদ্বেগ হলো বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধ। ট্রাম্পের শুল্ক নীতির জবাবে চীন, মেক্সিকো এবং কানাডার মতো দেশগুলো পাল্টা শুল্ক আরোপ শুরু করেছে। এর ফলে মার্কিন কৃষি খাত চরম সংকটে পড়েছে। ২০২৫ সালেই মার্কিন শস্য উৎপাদনকারী কৃষকরা প্রায় ৩৪.৬ বিলিয়ন ডলার লোকসান গুনেছেন। সরকার ১২ বিলিয়ন ডলারের একটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করলেও তা কৃষকদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে পারেনি। অনেক খামার দেউলিয়া হওয়ার পথে এবং ২০২৬ সালে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাবে বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধিও ২০২৬ সালে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি)।সামগ্রিকভাবে বলা যায়, ২০২৫ সাল ট্রাম্পের অর্থনীতির জন্য একটি ‘মরীচিকা’র মতো ছিল, যেখানে বিপর্যয় আসন্ন হওয়া সত্ত্বেও কিছু কৃত্রিম কৌশলে তা ঢেকে রাখা হয়। কিন্তু ২০২৬ সালে মজুত পণ্য শেষ হওয়া, উচ্চ সুদের হারের প্রভাব এবং পাল্টা বাণিজ্য যুদ্ধের ধাক্কা যখন একযোগে লাগবে, তখন মার্কিন অর্থনীতি একটি বড় ধরনের স্থবিরতা বা স্ট্যাগফ্লেশনের সম্মুখীন হতে পারে।নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ সাইমন জনসনের মতে, নিন্ম আয়ের আমেরিকানদের জন্য ২০২৬ সাল অত্যন্ত কঠিন একটি বছর হতে যাচ্ছে। ডনাল্ড ট্রাম্প যে ‘স্বর্ণযুগের’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, বাস্তব অর্থনীতি এখন তার উল্টো পথেই হাঁটছে।সূত্র: ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জেফরি ফ্র্যাঙ্কেলের নিবন্ধ এবং সম্প্রতি প্রকাশিত কিছু অর্থনৈতিক প্রতিবেদন।