বছরজুড়ে স্বর্ণের উত্থান-পতন, দাম বাড়ল ৮৬ হাজার টাকা

দেশের স্বর্ণবাজারে ২০২৫ সাল জুড়েই ছিল ওঠানামার ধারা। কখনো ঊর্ধ্বমুখী, কখনো আবার সামান্য স্বস্তি-এভাবেই কেটেছে পুরো বছর। তবে হিসাব বলছে, বছর শেষে এসে স্বর্ণের দাম আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে বড় অঙ্কে।বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর দেশে ২২ ক্যারেটের স্বর্ণের দাম ছিল ভরিপ্রতি ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৮৮ টাকা। এক বছর পর, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ এসে সেই দাম দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৪ হাজার ১৮২ টাকায়। অর্থাৎ এক বছরে দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৮৫ হাজার ৮৯৪ টাকা, যা শতাংশের হিসাবে প্রায় ৬২ দশমিক ১ শতাংশ বৃদ্ধি।এর মধ্যে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ৩ দফা; যার মধ্যে ৩ বারি বেড়েছে দাম, ফেব্রুয়ারিতে ৭ দফা; ৫ দফা বৃদ্ধি, ২ দফা হ্রাস পেয়েছিল স্বর্ণের দাম। এছাড়া গত মার্চে ৭ দফা (৫ দফা বৃদ্ধি, ২ দফা হ্রাস), এপ্রিলে ৯ দফা (৬ দফা বৃদ্ধি, ৩ দফা হ্রাস), মে ১০ দফা (৫ দফা বৃদ্ধি, ৫ দফা হ্রাস), জুনে ৪ দফা (২ দফা বৃদ্ধি, ২ দফা হ্রাস) ও জুলাইতে ৫ দফা (৩ দফা বৃদ্ধি, ২ দফা হ্রাস) সমন্বয় করা হয়েছিল দাম। আরও পড়ুন: ২০২৫ সাল: উত্থান-পতনে টালমাটাল স্বর্ণের বাজারআর গত আগস্টে ২ দফা (২ দফাই বৃদ্ধি), সেপ্টেম্বরে ১২ দফা (১০ দফা বৃদ্ধি, ২ দফা হ্রাস), অক্টোবরে ১৩ দফা (৮ দফা বৃদ্ধি, ৫ দফা হ্রাস), নভেম্বরে ৯ দফা (৬ দফা বৃদ্ধি, ৩ দফা হ্রাস) ও ডিসেম্বরে ১২ দফা (৯ দফা বৃদ্ধি, ৩ দফা হ্রাস) করা হয়েছিল স্বর্ণের দাম।গত ২৮ ডিসেম্বর সমন্বয় করে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করা হয় স্বর্ণের। সেদিন মূল্যবান এই ধাতুটির দাম নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ২৯ হাজার ৪৩১ টাকা।এদিকে সবশেষ গত ৩১ ডিসেম্বর স্বর্ণের দাম কমানোর ঘোষণা দিয়েছে বাজুস। সেদিন সন্ধ্যায় দেয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি জানায়, ভরিতে ২ হাজার ৭৪১ টাকা কমানো হয়েছে স্বর্ণের দাম। নতুন এই দাম কার্যকর হবে বৃহস্পতিবার (১ জানুয়ারি) থেকে।বাজুসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, স্থানীয় বাজারে তেজাবি স্বর্ণের (পিওর গোল্ড) দাম কমায় সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্বর্ণের নতুন মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ২২ ক্যারেটের এক ভরি স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ২৪ হাজার ১৮২ টাকা। এছাড়া ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি ২ লাখ ১৪ হাজার ৩৪ টাকা, ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি ১ লাখ ৮৩ হাজার ৪১৬ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৫২ হাজার ৮৫৭ টাকা। আরও পড়ুন: আরও কমলো স্বর্ণের দামবাজুস আরও জানিয়েছে, স্বর্ণের বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে আবশ্যিকভাবে সরকার-নির্ধারিত ৫ শতাংশ ভ্যাট ও বাজুস-নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি ৬ শতাংশ যুক্ত করতে হবে। তবে গহনার ডিজাইন ও মানভেদে মজুরির তারতম্য হতে পারে।এর আগে গত ২৯ ডিসেম্বরও স্বর্ণের দাম সমন্বয় করা হয়েছিল। সেদিন ভরিতে ২ হাজার ৫০৮ টাকা কমিয়ে ২২ ক্যারেটের স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ২৬ হাজার ৯২৩ টাকা। সে সময় ২১ ক্যারেটের দাম ছিল ২ লাখ ১৬ হাজার ৬০০ টাকা, ১৮ ক্যারেটের দাম ১ লাখ ৮৫ হাজার ৬৯১ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৫৪ হাজার ৭২৩ টাকা, যা কার্যকর হয় ৩০ ডিসেম্বর থেকে।সব মিলিয়ে চলতি বছরে দেশের বাজারে স্বর্ণের দাম সমন্বয় করা হয়েছে মোট ৯৩ বার। এর মধ্যে ৬৪ বার দাম বেড়েছে এবং ২৯ বার কমেছে। অন্যদিকে ২০২৪ সালে স্বর্ণের দাম সমন্বয় হয়েছিল মোট ৬২ বার, যার মধ্যে ৩৫ বার দাম বাড়ানো হয়েছিল এবং ২৭ বার কমানো হয়েছিল।বাজার সংশিষ্টদের মতে, বৈশ্বিক বাজারে স্বর্ণের দাম বৃদ্ধি, ডলারের ওঠানামা, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, ট্রাম্পের শুল্কারোপ, যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং বিনিয়োগকারীদের নিরাপদ সম্পদের প্রতি ঝোঁক-সব মিলিয়েই দেশে স্বর্ণের বাজারে এই বড় উত্থান-পতনের প্রভাব পড়েছে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহুদিন ধরেই স্বর্ণ ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হিসেবে পরিচিত, তবে সম্প্রতি এটিকে অনেকে ‘স্মার্ট ইনভেস্টমেন্ট’ হিসেবেও দেখছেন। স্বর্ণ সাধারণত অনিশ্চয়তার সময়ে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হয়। পাশাপাশি এটি একটি অ-ফলনশীল সম্পদ হওয়ায় কম সুদের পরিবেশে আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা, মার্কিন ডলার এবং ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার নিয়ে অনিশ্চয়তা চলমান থাকলে খুব শিগগিরই দাম ৫ হাজার ডলার পেরিয়ে যেতে পারে। তবে অস্থিরতা কমলে বাজার নিম্নমুখী হবে। আরও পড়ুন: সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ মজুত করেছে যেসব দেশব্যাংক অব আমেরিকা বলেছে, ২০২৬ সালে স্বর্ণের দাম প্রতি আউন্স ৫ হাজার ডলারে পৌঁছাতে পারে, যেখানে গড় দাম থাকবে ৪ হাজার ৪০০ ডলার। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালে বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম প্রায় ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে রুপার দাম, প্রায় ১৫০ শতাংশ। গুরুত্বপূর্ণ খনিজ হিসেবে স্বীকৃতি, সরবরাহ সংকট এবং শিল্প ও বিনিয়োগ চাহিদা বাড়ায় রুপার দাম দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে।বাজুসের তথ্য বলছে, ২০২৫ সালের ১৩ বার সমন্বয় করা হয়েছে রুপার দাম। এর মধ্যে বেড়েছে ১০ বার, আর কমেছে মাত্র ৩ বার। বর্তমানে দেশে ২২ ক্যারেটের এক ভরি রুপা বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার ৬৫ টাকায়। এছাড়া ২১ ক্যারেটের প্রতি ভরি ৫ হাজার ৭৭৪ টাকা, ১৮ ক্যারেটের প্রতি ভরি ৪ হাজার ৯৫৭ টাকা এবং সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি রুপা ৩ হাজার ৭৩২ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছে।