আর্থিক খাতকে রাজনীতিকীকরণের চরম ফলাফল আর জরাজীর্ণ পরিস্থিতি উন্মোচনের বছর ২০২৫। একদিকে, কারপেটের নিচে থাকা সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অন্যদিকে গ্রাহকের আমানত ব্যাংকে ফেরানোর নিশ্চয়তা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বাধাবিপত্তি পেরিয়ে রাষ্ট্রের অধীনে হয়েছে প্রথম শরিয়াহ ভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকের সূচনা।এই প্রথম সরকারের ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে একটি ইসলামী ব্যাংক। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে একীভূতকরণের মধ্য দিয়ে নতুন এই নাম দেয়া হয়েছে। ৭৫ লাখ আমানতকারী আর ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণের চাপ নিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা মূলধনের যোগান দিয়ে সম্মিলিত এই ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ছাড় দেয়ায় বছরের শেষে ব্যাংক খাতে সাড়ে ৬ লাখ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়ে বিব্রত ব্যাংক খাত। দুদফায় বিশেষ নীতি সহায়তায় ঋণ খেলাপির তালিকা থেকে নাম কাটাতে ও নির্বাচনী ছাড়পত্র পেতে হাজার খানেক রাজনৈতিক ব্যক্তি, শিল্প গোষ্ঠী ও ব্যবসায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের দুয়ারে। ফলে খেলাপি অর্থ ব্যাংকে ফেরানোর দৌড় নতুন বছরে ব্যাংকগুলোকে পরীক্ষায় রাখবে। এসআলমসহ খেলাপিদের সম্পদ জব্দ করা ও অর্থ পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জের সঙ্গে যোগ হবে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার চ্যালেঞ্জ। এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে বিদেশ থেকে অর্থ ফেরত আনায় বিগ ফোর আইনি সংস্থা। এদিকে মূল্যস্ফিতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদের হারে কঠোর অবস্থানে সংস্কারের মৌসুম জুড়ে। ১০.৮৯ শতাংশ দিয়ে শুরু হওয়া মূল্যস্ফীতি বছর শেষ প্রান্তে ৮.২৯ শতাংশে নেমে আসে। তবে দীর্ঘ কঠোরতা থেকে সরে আসছে মুদ্রানীতিতে নীতি সুদের হারে কিছুটা শীথিলতা আনার আভাস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। সুদের হারের কঠোরতা ও রাজনৈতিক সরকারের অপেক্ষায় ফলে প্রাইভেট সেক্টর ক্রেডিট গ্রোট রেট ছিল টানা পতন মুখী। জানুয়ারিতে ৭.১৫ শতাংশ থেকে তা বছরের সর্বশেষ প্রান্তিকে দাঁড়ায় ৬.২৩ শতাংশ। বছরে ব্যাংকখাতে ধারাবাহিকতা এগিয়ে রেখেছে রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। তবে অর্থনৈতিক মন্থরতায় আমদানি ঋণপত্র খুলতে ব্যাংকের পাশ দিয়ে হাঁটেনি বিনিয়োগকারীরা। ফলে বাজারে ডলারের তারল্য বেড়ে যাওয়া ঠেকাতে ২.৮৭ বিলিয়ন ডলার তুলে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে গ্রস রিজার্ভ ছাড়িয়ে যায় ৩২.৫৭ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ছাড়িয়ে গেছে ২৭.৮৭ বিলিয়ন ডলার। আরও পড়ুন: বাংলাদেশের দুর্বল ব্যাংক কিনতে চীনকে প্রস্তাব, কী বলছেন অর্থনীতিবিদরা? ব্যাংক খাত এ বছরও এসএমই খাতে ঋণ ছাড়ে আরও পিছিয়েছে। লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি বেশিরভাগ ব্যাংক। ফলে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের জন্য আবেদন করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে মাইক্রো ক্রেডিটের সক্ষমতার পরীক্ষায় ফেলে দেবে নিঃসন্দেহে। বিশ্লেষকরা মনে করেন আরও বেশি সুসংহত করা গেলে ব্যাংক ও আর্থিক খাত হবে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বেশি এগিয়ে যাওয়া খাত। তবে চলতি বছর সীমিত ও নিয়ম রক্ষার বাজেটের অর্থ যোগানে ব্যাংক ঋণ কমিয়ে ট্রেজারি বন্ডে ঝুঁকেছে সরকার। সরকারের ঋণের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল বিদেশি ঋণ। তবে নতুন সরকার এলে পাওয়া যাবে প্রত্যাশিত আইএমএফ-এর দুই কিস্তি। ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিতে ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ নীতিতে সংস্কার আনা ছাড়াও ব্যাংকের সংকটকালীন পুনরুদ্ধার বা অবসানের প্রক্রিয়া সহজ করতে ‘ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ ও আমানত বীমা ১ লাখ থেকে বাড়িয়ে দুই লাখ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায়। তবে ব্যাংকখাতকে রাজনীতির বাইরে রাখতে একক ও পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্বশাসন নিজের হাতে নিতে আইনি সংস্কার চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।